মধুরেণসমাপয়েৎ

                              মধুরেণসমাপয়েৎ

                                - সায়নী সরখেল (চক্রবর্তী)



লেখার আগে সবাইকে জানাই ভ্যালেন্টাইন্স ডে এর অনেক শুভেচ্ছা। গত স্পেশাল ডে গুলোর উইশ খুব বাজে ভাবে করেছি,কেউ রাগ করবেন না,আমি এমনই। ফেব্রুয়ারি মাসটা বলতে গেলে পুরোটাই কাপলদের জন্য। আজ এই ডে কাল ওই ডে,তার ওপর আবার আবার সরস্বতীপূজা যা বাঙালীর ভ্যালেন্টাইন্স ডে।একে তো রসমালাই তার ওপর আবার ক্ষীর।দিনগুলো নিয়ে অনেকেরই অনেক প্ল্যান আবার কিছু চিরসিঙ্গেলদের কাছে শুয়ে শুয়ে ল্যাদ খাবার যোগ্য সময়। যাইহোক, কথা না বাড়িয়ে চলুন গল্পে যাই। --------------------------------------------- কলেজ থেকে বের হয়ে কানে ফোন গুজে বাড়ির দিকে রওনা হলো বহ্নি,থুড়ি ফোন না হেডফোন। আপন মনে কথা বলতে বলতে বেখেয়ালি ভাবে সাপের মতো রাস্তা দিয়ে চলছিলো সে,যেন রাস্তা দিয়ে আর কেউ যাবেনা, ওটা ওর নিজস্ব।হঠাৎ করে পেছন থেকে এসে কেউ ধাক্কা মারতেই রাস্তায় কাদায় পরে গিয়ে মাখামাখি অবস্থা হয় বহ্নির। “ কোন শালারে ধাক্কা দিলি!!!!” বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় বহ্নি। ধাক্কা দেওয়া ব্যক্তি আর কেউ না,ছোটোবেলার বন্ধু তন্ময়। বন্ধু বললে হয়তো ভুল হবে,কেননা ক্লাস ১০ এর পর থেকে একে অপরের প্রতি টান জন্মেছিলো। কিন্তু একে অপরকে মনের কথা বলে ওঠা হয়নি। “এভাবে ধাক্কা দেওয়ার কারণটা কি????” “ কেনো ভুলে গেছিস সব???? তোকে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়া ছিলো আমার রোজকার স্বভাব”। “ ভুলতে যাবো কেন?? কিন্তু এখন তো আর সেই স্বভাব থাকার কথা না।যাই হোক কাজটা ভালো করলিনা। দেখতো কি হলো!!!” “ আচ্ছা আচ্ছা,সরি। চল আমার বাড়ি, ফ্রেশ হয়ে নিবি”। “ নো থ্যাংকস, আমি বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেব”। “ কি ভাব মাগো।আচ্ছা তাহলে চল তোর বাড়ি। এতো দিন পর দেখা হলো নিজে থেকে তো বললি না একবারও।আমি হ্যাংলার মতো বললাম”। “ এতো বাড়তি কথা কেনো বলিস বলতো!!!! চল”। প্রায় ৯ বছর পর একে অপরের মুখোমুখি হলো বহ্নি আর তন্ময়। দুজনের লাস্ট দেখা কলেজের শেষ দিনটাতেই হয়েছিল। তারপর অবশ্য নিজের প্রয়োজনে করতে চেয়েছিল তন্ময় কিন্তু বহ্নি আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি। স্কুলে থাকাকালীন দুজনের সম্পর্ক ভালোই ছিলো। পড়াশোনায় একে অপরকে হেল্প করা,আড্ডা দেওয়া, হাসি ঠাট্টা খুনশুটি সবই হতো কিন্তু দূরত্ব তৈরি হয় কলেজ লাইফের এক ঘটনার পর থেকে। তন্ময়ের বহ্নির প্রতি কতটা উইকনেস ছিলো সেটা বড়ই মুশকিল হয়ে যায় বোঝা কেননা কলেজে ওঠার পর থেকে প্রায় সব মেয়েদের পেছনে ঝারি মারা তার স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়।যেহেতু একই স্ট্রিমে দুজন ছিলো তাই নিজের নোটস থেকে শুরু করে প্র‍্যাক্টিকাল সবই বহ্নি কে দিয়ে করাতো তন্ময়। তাতে বহ্নি কোনোরকম রাগ হতোনা যেহেতু সে মনেমনে ভালোবাসত তন্ময়কে।কিন্তু শেষ অবধি তার ভুল ধারণা ভাঙতে হলোই। ফার্স্ট এপ্রিল বন্ধুবান্ধবদেরদের সামনে বহ্নিকে গোলাপ হাতে দিয়ে আই লাভ ইউ বলার পর সেই গোলাপ নিয়েই হাসতে হাসতে সুমনাকে প্রোপোজাল দেয় তন্ময়। তখন বহ্নিকে হাত চেপে “তুই তো আমার বুদ্ধু বেস্টুরে” এই কথাটাই বলেছিল।ঘটনাটা তন্ময়ের কাছে ইয়ার্কি হলেও বহ্নির খারাপ লেগেছিল খুবই। আস্তে আস্তে তন্ময়ের থেকে দূরে যেতে থাকে বহ্নি। দূরত্ব বেড়ে যায় দুজনের। সুমনা যে তার কাছে শুধুমাত্র ভালোলাগা তা বছর ঘুরতেই বুঝে যায় তন্ময় ।তারপর আরও এক-দুজনের সাথে সম্পর্কের চেষ্টা করলেও তা ভালোলাগা অবধিই পৌঁছায়,ভালোবাসা হতে পারেনি।তবে এমন কোনো দিন ছিলোনা যে বহ্নিকে সে মিস করেনি। “তুই এতো সিরিয়াস কবে থেকে হয়ে গেছিস রে???? আগে তো সারাদিন ভ্যাগভ্যাগ করে মাথা শেষ করতিস”। “কে বললো তোকে আমি সিরিয়াস হয়ে গেছি?? আসলে কিছু কাজের চাপে আছি তাই একটু টেনশন আর কি।ওসব ছাড়,সুমনা কেমন আছে??? বিয়েতে তো ইনভাইটও করলিনা”। “হুস্,ওর সাথে আমার ব্রেকাপ সেই কবে হয়ে গেছে, বিয়ে তো দূর।তোকে কত ফোন করেছি একটাবারও তুলিসনি।আমার মনের কথা শেয়ার করার তুইই ছিলি একজন, তুইও চলে গেলি দূরে।ভাগ্যভালো পরশু যিশুর সাথে কথায় কথায় উঠলো তোর কথা। তখন ও বললো তুই এই কলেজে জয়েন করেছিস।তাই চলে এলাম”। “বা বা!!!!! এতো টান!!!!!! আমার ভাগ্য এতো ভালো জানতামই না আমি।খবর পেয়ে কাজ ফেলে চলে এলি???” “হুর,ও তো বোনের বিয়ের টুপি পড়িয়ে ছুটি নিয়ে এসছি”। “এদিকে তো সাতকুলে কোনো বোনই নেই। জানতে পারলে চাকরি খেয়ে নেবে”। “হ্যাঁ এখন আমি একদমই একা।মা তো সেই কবেই ছেড়ে চলে গেছে।আর বাবার কথা তো জানিসই”। “হুমম, ছাড় ওসব। ফ্রেশ হয়ে নে।খাওয়াদাওয়া করেছিস???” “না আজ খাওয়া হয়নি,একটু কাজ ছিলো” “কিছু রান্না করিনি। সেদ্ধভাত খাবি তো???” “আরে হ্যাঁ হ্যাঁ তাই দে।আমার হোটেল খরচা একবেলার তো বাঁচবে”। “কিপটা শালা…” বলে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের কাজ শুরু করে বহ্নি। তখন ঘড়িতে প্রায় ৫ টা,কলিংবেলের আওজায় পেয়ে দরজা খোলে বহ্নি। খুলতেই মামমাম বলে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে বহ্নির তিনবছর বয়সী মেয়ে শ্রেষ্ঠা। কি বলা উচিত বা কি বলবে তা কিছুই ভেবে পাচ্ছিলো না তন্ময়। বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। মনে মনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে এসেছিলো যে হাজার ভালোলাগাকে পেছনে ফেলে নিজের ভালোবাসাকে আপন করে নেবে। নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে বহ্নির সাথে বাকি জীবন কাটাবে। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে ওসব তো দূর চোখের কোনায় জল জমা শুরু হয়ে গিয়েছিল। “ কিরে!!!!!! হা করে কি দেখছিস তুই????” “তোর মেয়ে???? তুই বিয়ে করে ফেলেছিস???? এতোক্ষণ এতো কথা বললাম একবারও তো বললি না!!!!! শাখা সিঁদূর কোথায়???? এই বর কোথায় তোর????” “ ওরে বাবারে…. থাম থাম। দম নিয়ে নে।কতো প্রশ্ন বাবা!!!! চোখে জল কেনো তোর???? খুশিতে কাঁদছিস????” “ ইয়ার্কি মারিসনা বহ্নি প্লিজ। চললাম আমি,ভালো থাকিস”। বলে চলে যেতে নেয় তন্ময়। “ওহ্ একটা গিফট এনেছিলাম তোর জন্য, এই নে।ভালো লাগলে রাখিস আর নাহলে ফেলে দিস। হয়ত হাসবেন্ড রাগ করতে পারে দেখলে….. চলি” বলে ব্যাগ থেকে গিফটটা বের করে হাতে দিয়ে বের হয়ে যায় তন্ময়। কিছুক্ষণ পর আবার ঘুরে আসে।বহ্নি চুপই ছিলো কেননা ঘুরে ঘুরে আসার স্বভাব তন্ময়ের আগাগোড়াই ছিলো এটা বহ্নির ভালোমতোই জানা। “এই সত্যি বিয়ে করেছিস!!!!!” “স্বভাব এখনো গেলো না তোর তাইনা!!!!! করিনি আমি বিয়ে”। “ইয়ার্কি মারবিনা। মামমাম বলে ডাকলো।আমি কি কানে কালা নাকি!!!!!” “ না তোর কান একদম পরিষ্কার। তুই ঠিকই শুনেছিস।তবে আমি বিয়ে করিনি”। “ এতো হেয়ালি ভালোলাগেনা।ধুর……” বলে আবার চলে যায়। “এই সত্যি বলনা এমন কেনো করছিস????” “কতোবার ঘুরে আসবি????আর আমি বিয়ে করেছি নাকি করিনি তাতে তোর কি??? তোর তো বউ আছে”। “ধুর আমি বিয়ে করিনি প্রেমও করিনা।বলনা রে… এমন কেনো করছিস!!!!” “তুই জেনে করবি টা কি বল। কি দরকার তোর জানার????” “আছে দরকার আছে। খুব দরকার আছে। কেননা……..” “কেননা কি?????” “কিছুনা…” “বল…” “না….” “ভালোবাসিস…” “হ্যাঁ….. কি করে বুঝলি????” “বুদ্ধু আমি না,বুদ্ধু তুই।চোখের জল গুলো শুধুশুধু পড়ছে নাতো। কারণ তো এটাই”। “আর জল পরলেই কি বা না পরলেই কি।তুই তো অন্যকারোর স্ত্রী এখন। ভালোবাসার কথা এখন বলে কি হবে আর।লেট করে ফেললাম খুবই। কলেজে যদি ওইদিন তোর সাথে ইর্য়াকিটা না মেরে সত্যি বলতাম তাহলে হয়তো আজ আমাকে এই দিন দেখতে হতো না।তুই কষ্ট পেয়েছিলি ওইদিন আমি জানি। তাই আমার সাথে কথা বলতি না ওত।পরে আর কোনো যোগাযোগও করিসনি।যাই হোক,ক্ষমা করে দিস বহ্নি। ভালোথাকিস…. চলি”। “ বিয়ে করিনি। যাকে ভালোবেসেছিলাম তাকে পাইনি।করতে পারতেম বিয়ে কিন্তু একটা রাগ ভেতরে খুবই হতো ।ইচ্ছে করতো তোকে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলি।তুই ভালোমতো বুঝতি যে আমি তোকে ভালোবাসি তাও ওমন করেছিলি সেদিন। ভালোবাসা শব্দটার প্রতি কোনোরকম সম্মান আর ছিলো না।তাই সিঙ্গেল মাদার।এখন ভালোবাসি আমার মেয়েকেই। আমার সবটা জুড়েই এখন ও।খারাপ সময় দিয়ে একাই এসেছি তাই আর কাওকে দরকার পরেনি আমার”। “পারবিনা ক্ষমা করতে????? দিবিনা একটুও জায়গা তোর মনে???? আমি চাকরি ছেড়ে দেবো।তোর বাড়িতে কাজের লোক হয়ে থাকবো।তোকে রান্না করে খাওয়াবো।আমার নিজের মেয়ের মতো ওকে ভালোবাসবো, ওর দেখাশোনা করবো যখন তুই থাকবিনা,বাসন মেজে দেবো,কাপড় কেচে দেবো সব করে দেবো।শুধু আমাকে তোর মনে একটু জায়গা দে প্লিজ। ক্ষমা করে দে।আমি তোর পায়ে মাথা ঠুকছি নিজের…” “ আরে ওঠ ওঠ…. এমন করিসনা। আমার মেয়ে দেখলে হাসবে।এতো কথা বলা আমি পছন্দ করিনা।কলেজে পড়াই এখন, রাগি ম্যাডাম আমি।আগের মতো ছ্যাবলা নেই আর।যা রাতের বাসন গুলো পরে আছে মেজে ফেল…..” বলে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরে তন্ময়কে। “কাঁদার কি আছে পাগল!!!!! ভালো আজ অবধি তোকেই বেসে এসেছি আর তোকে ক্ষমা করতে পারবোনা তা হয়।তোকে পাইনি বলেই আজ অবধি আর কাওকে ভালোবাসতে পারিনি কিন্তু তোকে তো ভালোবাসি”………. সমাপ্ত ……………………………. [বিঃদ্রঃ -শুধুমাত্র গল্পই।বাস্তবের সাথে মেলাতে যাবেননা প্লিজ।বাস্তব খুবই কঠিন আমাদের। আর যদি কার‌ও বাস্তবিক জীবন এই গল্পের সঙ্গে মিলে গিয়ে থাকে তবে সে সত্যি‌ই বিরাট ভাগ্যবান।]

Comments

Popular posts from this blog

Prem Mane Ato Kichhu by TIRTHARAJ BHATTACHARJEE

বাস্তব by TIRTHARAJ BHATTACHARJEE

মেঘলা by TIRTHARAJ BHATTACHARJEE